ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম


 ইংরেজি Secular এবং Secularism শব্দদ্বয়ের বাংলা করা হয়েছে যথাক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ।Secularism ল্যাটিন শব্দ Secularies থেকে উদ্ভূত। চেম্বারস ডিকশনারির মতে Secularism হচ্ছে “The belief that the state morals, education should be independent of religion.” অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে এমন এক বিশ্বাস যার মতে রাষ্ট্র, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছু ধর্মমুক্ত থাকবে।

Oxford Dictionary এর বর্ণণামতে, “Secularism means the docrine that morality should be based solely on regard to the well being of mankind in the present life to be exclusion of all considerations drawn from belief in God or in future state.” অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে এমন এক মতবাদ যা মনে করে আল্লাহ বিশ্বাস বা পরকাল বিশ্বাস নির্ভর সমস্ত বিবেচনা থেকে মুক্ত থেকে মানব জাতির বর্তমান কল্যাণ চিন্তার উপর ভিত্তি করে নৈতিকতা গড়ে উঠবে। Random House Dictionary of the English Language এ Secularism এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে হুবহু এভাবে:
  1. Secular spirit or tendency, especially a system of political on social philosophy that rejects all forms of religions faith.
  2. The view that public education and other matters of civil society should be conducted without the introduction of a religious element.

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে সেই রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শন, যা সকল ধর্মবিশ্বাসকেই প্রত্যাখান করে (rejects all forms of religious faith)। Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষতার একমাত্র অর্থ ধর্মহীনতা, কোন ধর্মের অন্তর্গত না থাকা, ধর্মদ্রোহিতা। Secularism এর অন্যকোন অর্থ বা সংজ্ঞা নেই।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তাই এমন এক মতবাদ যার উৎসমূল হিসেবে বিবেচনা করা যায় যা ঐশ্বরিক নয় বরং এ মতাদর্শ সম্পূর্ণভাবে মানব রচিত। এর দার্শনিক ভিত্তি মানুষ ও স্রষ্টার পৃথকীকরণের মধ্যে নিহিত। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে প্রতারক (deceiving) শব্দ। এ শব্দটি কখন কি রুপ পরিগ্রহ করে বলা মুশকিল। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ধর্মহীনতার মধ্যে কার্যক্ষেত্রে পার্থক্য করা খুবই দুরুহ বলা যায় অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে ডা. হাসানুজ্জামান চৌধুরী লিখেছেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল কিছু খারাপই নয়, এটি সত্য বিধ্বংসী ইবলিসী কালকুট।” ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সামান্যতম ছাড় দেয়াটাও একজন ঈমানদার মুসলিমের পক্ষে অসম্ভব। আর নিশ্চয়ই কোন মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ নয়, আর যে ধর্মনিরপেক্ষ সে মুসলিম নয়, খোদাদ্রোহী। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একমাত্র সত্য, পূর্ণাঙ্গ, মনোনীত দ্বীন হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ ও প্রসার করার ঘোষণা দেয়ার পর আর কোন মানবরচিত দ্বীন, ধর্ম, বিভিন্ন ধর্মের সহযোগে ককটেল বা সত্য-মিথ্যার, হক-বাতিলের, নূর-জুলুমের সহাবস্থানরুপী ব্যবস্থারুপ ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পূর্ণ গুমরাহি ও ইবলিসী কারবার। দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা তথা ইসলামের প্রশ্নে কোন আপোষ, ছাড় নেই; মিথ্যার সাথে সহাবস্থান নেই, দ্বীনকে ব্যক্তিগত জীবনে আবদ্ধ রাখার বিষয়ও নেই। সমগ্র জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাধনা ও সাংগ্রামই কেবল গ্রহণযোগ্য।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল কথা-
১. রাষ্ট্র বা রাজনীতির সাথে ধর্ম সংযুক্ত থাকবে না।
২. ধর্ম থাকবে ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে।
৩. রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ ও পরিচালনায় কোনভাবেই ধর্মকে বিবেচনা করা হবে না।
৪. মুসলিম বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ইসলাম মুক্ত শাসন, ইসলামকে ব্যক্তির একান্ত জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
৫. ইসলাম থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সম্পূর্ণ পৃথক করা। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে ইসলামের সাথে সম্পর্কহীনভাবে দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে পরিচালনা করার মতবাদ।
৬. ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হচ্ছে রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি তথা সমাজ সংশ্লিষ্ট সবকিছুকে ধর্মহীন করা, ইসলাম মুক্ত করা।
৭. ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কার্যত রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মহীনতা

রাজনৈতিকভাবে যারা ধর্মনিরপেক্ষ তারা ধর্মকে মনে করেন এক শ্বেতশুভ্র বস্ত্রখন্ডের ন্যায় যা রাজনীতির ময়দানে টেনে নিয়ে আসলে কালিমালিপ্ত হবে। এদের বিবেচনায় ধর্ম রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিশুদ্ধ করার পরিবর্তে নিজেই সমাজ ও রাজনীতির পঙ্কিলতায় সমর্পিত হয়। পক্ষান্তরে যাদের অবস্থান ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে তারা ধর্মকে নিষ্ক্রিয় বস্ত্রখন্ডের পরিবর্তে সক্রিয় ডিটারজেন্টের সাথে তুলনা করেন যা তার অন্তর্গত ক্ষমতা দিয়ে রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকেও শুভ্র ও পবিত্র করবে। ধর্ম যদি অবশ্য পালনয়ি আদেশ-নিষেধ ও উপদেশ সাবধানতার সমষ্টি হয়ে থাকে তাহলে তার তুলনা শুচীশুভ্র বস্ত্রখন্ডের পরিবর্তে পরিচ্ছন্নতার ক্ষমতাসম্পন্ন ডিটারজেন্ট বা সাবানের সাথে হওয়াই বাঞ্ছনায়। সুতরাং রাজনীতিতে ধর্ম টেনে না আনার দাবি নেহায়েত অজ্ঞতাপ্রসূত এবং একবোরেই অগ্রহণযোগ্য।
রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রবেশ নিষিদ্ধকরণের অযৌক্তিক প্রস্তাবনা সমাজ ও সভ্যতার জন্য খুবই ক্ষতিকর। উদাহরণ স্বরুপ একজন ব্যক্তি তার ধর্মাচরণের কারণে ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও ন্যায়বান। এই ব্যক্তি তার রাজনৈতিক জীবনে ধর্মাচার না করার অর্থ হচ্ছে তিনি জালভোট দিতে পারবেন। অন্যের কুৎসা রটাতে পারবেন, গুজব ছড়াতে পারবেন, এক কথায় যাবতীয় অন্যায় করার জন্য তিনি লাইসেন্সপ্রাপ্ত। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চললে তিনি এসব অপকর্ম করতে পারতেন না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রাজনীতিতে ধর্মকে প্রবেশাধিকার দিতে যারা কুন্ঠিত তারা প্রকৃতপক্ষে এক বল্গাহীন রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রত্যাশা করে থাকেন যা তাদের অসুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক।


ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মধ্যে পার্থক্য

ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পার্থক্যসমূহ নিম্নরুপ:

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
ইসলাম
১. মানব রচিত মতবাদ। Man made in origin
১. আল্লাহ প্রদত্ত। Divine in origin
২. ইহজগত মুখী, এ পৃথিবী কেন্দ্রীক। This worldly orientation.
২. ইহকাল ও পরকাল উভয়ের উপর সমানভাবে গুরুত্ব দেয়। Emphasizes this world and the hereafter.
৩. যুক্তি, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা, নিরীক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। Emphasizes reason, observation and experience.
৩. অহি বা প্রত্যাদেশ, যুক্তি, পরিবেশন ও অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্বারোপ করে।Emphasizes revelation, reasons, observation and experience.
৪. বল্গাহীন প্রবৃত্তির ইচ্চাভিত্তিক মানবতাবাদে বিশ্বাসী। Believed in humanism.
৪. ইসলামী শরীয়ার সীমারেখার মধ্যে থেকে মানবতাবাদে বিশ্বাসী। Believes in humanism but within the framework of shariah.
৫. ধর্ম ও রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা করে রাখে। Separates religion and politics.
৫. ধর্ম ও রাজনীতিকে একসূত্রে গ্রথিত করে।Integrates religion and politics.
৬. ধর্মকে শুধু ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করে।Relegates religion to personal sphere.
৬. ইসলাম বিশ্বাসীগণের জীবনের সকল দিক ও বিভাগকেই নিয়ন্ত্রণ করে। Islam governs all aspects of a believer’s life

Secularism মুসলিম বিশ্বের জন্য এক ক্ষতিকর মতবাদ। এ হচ্ছে এক অভিশাপ। এ মতবাদের প্রসার মানে ইসলামের ক্ষতি, মুসলিম ঐক্য নস্যাৎ করা। Secular মতবাদ মুসলিম বিশ্বের স্বতন্ত্র, স্বকীয়তার এমনকি স্বাধীনতার জন্যও হুমকি। Secular ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার ভুলুন্ঠিত হতে বাধ্য। অতএব Secularism এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, লড়াই করা ঈমানদার জনগণের আশু কর্তব্য।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম Reviewed by Younus B A Noor on 5:05:00 PM Rating: 5
Powered by Blogger.